সূচনা
শৃঙ্খলা হলো মানুষের জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। প্রতিকূল প্রাকৃতিক পরিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে শৃঙ্খলার নানাবন্ধন তৈরি করেই মানুষ অর্জন করেছে শ্রেষ্ঠত্ব, নির্মাণ করেছে সভ্যতা। এভাবেই ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও কর্মজীবনেশৃঙ্খলার পাঠ নিয়েছে মানুষ। সে অভিজ্ঞতায় দেখেছে, তার প্রতিটি কর্মের জন্যে প্রয়োজন হয় সুষম সমন্বয়ের। তার জন্য দরকারশৃঙ্খলা। সুশৃঙ্খল জাতিই নিশ্চিত করতে পারে জাতীয় জীবনে ব্যাপক উন্নতি ও অগ্রগতি।
প্রাণিজগতে শৃঙ্খলা :
প্রাণিজগতের সর্বত্র শৃঙ্খলার লীলাখেলা চলছে। নিয়ম না মানলে প্রাণিজগত হয়ে উঠে বিশৃঙ্খল। পাখিরা সকালে জেগে গান করে, দিন খাদ্যান্বেষণে ঘুরে বেড়ায়, রাতে বিশ্রাম করে, এদের সব কিছুই রুটিনমাফিক হয়ে থাকে। মৌমাছি, পিপীলিকা দল বেঁধে তাদেরনেতার নির্দেশ মেনে চলে। মৌমাছি অপূর্ব মৌচাক রচনা করে সুশৃঙ্খলভাবে জীবনযাপন করে।
সমাজ জীবনে শৃঙ্খলা :
শৃঙ্খলা ছাড়া সামাজিক জীবন চলতে পারে না। বিভিন্ন সামাজিক আচার-অনুষ্ঠান যেমন- বিবাহ, ঈঁদ-পূজা, খাওয়া-পরা সবকিছুইনিয়ম অনুযায়ী হয়ে থাকে। নিয়ম না থাকলে সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা থাকে না। সমাজে কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলা আছে বলেই আমরাআত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব মিলে সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে বসবাস করতে পারি। মোট কথা, নিয়মানুবর্তিতা সমাজ জীবনকে সুন্দর করেতোলে। তাই কবির ভাষায়...
“যে সমাজে শৃঙ্খলা আছে, ঐক্যের বিধান আছে,
সকলের স্বতন্ত্র ও সধিকার আছে,
সেই সমাজেই পরকে আপন করিয়া লওয়া সহজ।”
--------------রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
মানব জীবনে শৃঙ্খলা :
মানুষ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। অন্যান্য প্রাণী থেকে তার পার্থক্য সে বুদ্ধিমান ও নিয়রেম পূজারী। নিয়মানুবর্তিতা বা শৃঙ্খলাবোধ না থালেমানব জীবনকে সুন্দর ও সার্থক করে তোলে। মানুষকে আহার-বিহর, শ্রম-বিশ্রম, চাল-চলন ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে চলতেহয়। যে ব্যক্তি যথানিয়মে নিজ কর্তব্য সম্পাদন করে, তার উন্নতি অবধারিত। মানব জীবনে শৃঙ্খলার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে M. K. Gandhi বলেছেন.......
“Discipline maintains system,
System maintain development,
Development vibrates human-life.
So discipline must be followed.”
সৈনিক জীবনে শৃঙ্খলা:
শৃঙ্খলার উপযুক্ত চর্চা হয় সৈনিক জীবনে। দলনেতার হুকুম পালন করা তাদের প্রধান কর্তব্য। সকালে ঘুম থেকে উঠা, প্যারেড করা, খাওয়া, ঘুমান সবকিছুই তাদের নিয়মমাফিক করতে হয়। নিয়মানুবর্তিতার প্রতি সৈনিক জীবনে জোর দেয়ার কারণ হচ্ছে একজনেরসামান্য নিয়মভঙ্গের কারণে হাজার হাজার সৈন্যের জীবন বিনষ্ট হতে পারে। তাই নিয়মভঙ্গের কারণে তাদের কঠিন শাস্তির সম্মুখীনহতে হয়।
প্রকৃতির বুকে শৃঙ্খলা
প্রকৃতির সর্বত্র শৃঙ্খলা বিরাজমান। সেখানে কোথাও শৃঙ্খলার অভাব নেই। তার সবকিছুই সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রিত। প্রকৃতির সুশৃঙ্খলনিয়মে সকালে সূর্য ওঠে, সন্ধ্যায় অস্ত যায়। রাতের আকাশে উঁকি দেয় চাঁদ ও তারা। দিবারাত্রির এই পরিক্রমার পথ বেয়ে প্রকৃতিতেচলে ষড়ঋতুর আবর্তন। প্রকৃতির এই নিয়মের বন্ধনে বাঁধা মানুষের জীবন ও অস্তিত্ব। তাই প্রকৃতির মতােই মানুষের জীবনেঅনিবার্যভাবে এসে পড়ে শৃঙ্খলার দায়।
ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনে শৃঙ্খলা
ব্যক্তিজীবনের বিকাশের সঙ্গে রয়েছে শৃঙ্খলার যোগ। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের ব্যক্তিজীবন নানা নিয়ম-শৃঙ্খলার বন্ধনে বাঁধা।এই শৃঙ্খলা যেন মানুষের জীবনে চলার ছন্দ। সে ছন্দ ব্যক্তিজীবনকে শান্ত, সুস্থির, ফলপ্রসূ করার অবলম্বন। তা যেন সমাজ ওজাতীয় জীবনে অগ্রগতি নিশ্চিত করার চালিকাশক্তি। তাই মানুষের উন্নতি ও কল্যাণ নিশ্চিত করার স্বার্থেই অনেক নিয়ম গড়েতুলেছে সমাজ। সেসব নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে বিকশিত হয় মানুষের ব্যক্তিত্ব, মনুষ্যত্ব ও প্রতিভা।
ছাত্রজীবনে শৃঙ্খলা
শিক্ষিত মানুষের সুশৃঙ্খল জীবনের ভিত্তি রচিত হয় ছাত্রজীবনে। যতটুকু মেধা নিয়েই মানুষ জন্মাক না কেন, সুশৃঙ্খল জীবনছন্দেরঅভাবে প্রায় ক্ষেত্রেই সেসব মেধা ও শক্তির অপচয় হয়। সময়ানুবর্তিতা ও নিয়মানুবর্তিতার মেলবন্ধনে ছাত্রজীবনে অর্জিত হয়শৃঙ্খলার ছন্দ। এক্ষেত্রে ছন্দপতন ঘটলে জীবনে বিপর্যয় ঘটতে পারে। বস্তুত, জীবনের গঠনপর্বে শৃঙ্খলাবোধের বীজ আবাদ করলেইমানবজীবনে একসময় সোনা ফলে।
শৃঙ্খলাবোধ অর্জনের উপায়
শৃঙ্খলাবোধ আত্মস্থ করার জন্যে অবশ্যই কতিপয় রীতিনীতি অনুসরণ করা জরুরি। প্রথম প্রয়োজন সামাজিক রীতিনীতি মেনেচলা। দ্বিতীয়ত প্রয়োজন আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। মর্যাদা অনুসারে মানুষের সঙ্গে শ্রদ্ধা, প্রীতি ও স্নেহের সম্পৰ্ক অনুসরণ হয়।প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ ধর্মমোতাবেক শিক্ষা অর্জন করা। প্রত্যেক পরিবারের অভিবাবকদের উচিত তাদের সন্তানদের পড়াশুনারপাশাপাশি শৃঙ্খলাবোধের প্রতি গুরুতারোপ করা। কারণ ছাত্রজীবনই হলো শৃঙ্খলা অর্জনের প্রথম ধাপ।
আমাদের অগ্রযাত্রাকে স্তব্ধ করে দিতে পারে বিশৃঙ্খলা। আর তাই স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হওয়া ও মাদকমুক্ত জীবনযাপন অবশ্যইশৃঙ্খলাবোধের পর্যায়ভুক্ত। কায়িক পরিশ্রম কখনাে মানুষকে ছোট করে না বরং স্বাস্থ্যের জন্যে তা জরুরি। এভাবে শারীরিক শৃঙ্খলানিশ্চিত করা সম্ভব। বিশৃঙ্খলা পরিহার করে জীবনকে সুন্দর করার জন্যে শৃঙ্খলাবোধের বিকল্প নেই। সুশৃঙ্খল জীবনে প্রতিটি মুহূর্তেরসদ্ব্যবহার হয়। মহান ব্যক্তিদের জীবনে তার দেখা যায়। চিন্তা ও কর্মে শৃঙ্খলা অনুসরণ করলে মানুষ মহৎ এবং কর্তব্যপরায়ণ ব্যক্তিহিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে পারে। দায়িত্বের প্রতি সৎ ও একাগ্র থাকাটাও শৃঙ্খলার এক মৌলিক অংশ। নাগরিক জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যনিশ্চিত করার জন্যে সুশৃঙ্খল জীবনযাপন অপরিহার্য।
শৃঙ্খলাবোধ ও যান্ত্রিকতা
শৃঙ্খলা কাম্য হলেও কখনো কখনো শৃঙ্খলার বাড়াবাড়ি জীবনের স্বাভাবিক গতিচ্ছন্দের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। নিয়ম ও নিয়ন্ত্রণেরআতিশয্য যদি শৃঙ্খলা না হয়ে শৃঙ্খল হয়ে পড়ে তাহলে জীবনের স্বাভাবিক বিকাশ ব্যাহত হতে বাধ্য। মানুষের জীবন তখন যন্ত্রেরজীবনে পরিণত হয়। এ সম্পর্কে সতর্ক থাকা উচিত। মনে রাখতে হবে, জীবন-অনুগামী শৃঙ্খলার স্বাভাবিক ধাউঠতেই জীবনস্বচ্ছন্দে বিকশিত সৌন্দর্য। অশিষ্ট আচরণ, অন্যায় জবরদস্তি, অবৈধ পেশিশক্তি মানুষের জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যকে তছনছ করে দেয়।এসব জাতীয় অগ্রগতির পথেও মারাত্মক বাধা হয়ে দাঁড়ায়। পক্ষান্তরে, জাতীয় উন্নতি আর সার্বিক অগ্রগতির ভিত্তি হচ্ছে ব্যক্তিরশৃঙ্খলাবোধ। প্রতিটি ব্যক্তির সুশৃঙ্খল চিন্তা, কর্ম ও আচরণের শক্তিতেই জাতি বিশ্বসভায় মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে।
উপসংহার
শৃঙ্খলা মানুষকে সমৃদ্ধির দিকে ধাবিত করে। শৃঙ্খলাই হচ্ছে ব্যক্তি ও জাতীয় জীবনের সুষমাময় করতে শেখা সামাজিক শৃঙ্খলারপ্রাথমিক পদক্ষেপ। শৃঙ্খলাবােধ অর্জনের ক্ষেত্রে উত্তম নৈতিকতা ও শিষ্টাচারের অনুশীলন দরকার। জ্ঞান ও চিন্তার প্রসারতাওশৃঙ্খলাবোধ অর্জনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।